নিউইয়র্ক ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পণ্যের সাপ্লাই চেইনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে কমপ্লায়েন্সে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এ বিষয়ে আইনও পাস হয়েছে।
বিশ্বের ফ্যাশনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেটে সম্প্রতি একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে, যাতে ফ্যাশনের বড় ব্র্যান্ডগুলোসহ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত পক্ষগুলোকে এ্যাকাউন্টেবিলিটির মধ্যে আনা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোন স্টেট হিসেবে নিউইয়র্কে ফ্যাশন সাস্টেইনেবিলিটি অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট নামে আনা এ বিলটি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নিউইয়র্ক ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পণ্যের সাপ্লাই চেইনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে কমপ্লায়েন্সে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এ বিষয়ে আইনও পাস হয়েছে। কোম্পানিগুলো যাতে তাদের পুরো সাপ্লাই চেইনে হিউম্যান রাইটস ও এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন মানার বাধ্যবাধকতার মধ্যে আসে, সেটি নিশ্চিত করতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এতে সাপ্লাই চেইনের অন্যতম পার্ট হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারীদের উপর কী ধরনের প্রভাব আসতে পারে?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি উৎপাদন বাজারের অনিবার্য ভবিষ্যত। ফলে এই ধরনের ব্যবস্থাকে আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদকদের আরও কমপ্লায়েন্স ও অ্যাকাউন্টেবিলিটির মধ্যে আসতে হবে। এজন্য প্রাথমিকভাবে বাড়তি ব্যয়ের একটি ধাক্কা আসতে পারে।
তবে পরিস্থিতির আলোকে এসব কমপ্লায়েন্সের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের সামনে উজ্জল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
আর পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল আলাদা আলাদা নিয়মকানুন তৈরি করে তাদের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর বদলে ইউনিফাইড কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তবে তাদের বেশিরভাগই মনে করছেন, আমদানিকারক দেশগুলোর এমন উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের উৎপাদনকারীদের জন্য বড় ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনটি বিশ্বব্যাপী পোশাক এবং পাদুকা তৈরি কোম্পানিগুলোর জন্য প্রযোজ্য হবে। যেসব কোম্পানির ১০০ মিলিয়নেরও বেশি রাজস্ব রয়েছে এবং যারা নিউইয়র্কে ব্যবসা করছে, এমন কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হবে এটি।
এই ধরনের কোম্পানিগুলোকে তাদের সাপ্লাই চেইনের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ম্যাপ করতে হবে। ফার্ম থেকে শুরু করে যেখানে কারখানা এবং শিপিংয়ের মাধ্যমে কাঁচামাল উৎপন্ন হয়, সবখানে ম্যাপ করতে হবে তাদেরকে।
ন্যায্য মজুরি, শক্তি, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, পানি এবং রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোন ক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বেশি সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে তা প্রকাশ করতে হবে কোম্পানিগুলোকে। এসব প্রভাব, বিশেষ করে কার্বন নির্গমন কমানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে তাদেরকে।
সবশেষে, কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রকাশ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কতটা তুলা বা চামড়া বা পলিয়েস্টার বিক্রি করে সেই তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি রুবানা হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এর মানে সরবরাহকারীদের ওপর চাপ বাড়বে।"
"বর্তমানে বিশ্বে সবক্ষেত্রেই রয়েছে দায়বদ্ধতা। সব পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। যতক্ষণ সস্তা পণ্যের খেলা চলছে, ততক্ষণ টেকসইতার দিকে ব্র্যান্ডগুলোর কোনও পদক্ষেপ অবহেলা করা হবে এবং সরবরাহকারীর উপর ফেলা চাপও বৃথা যাবে," তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, "পণ্যের ধরন অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে, মূল্যের কাঠামো আরও ভালোর দিকে সংশোধন করতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত টেকসই ব্যবসায়ী ব্যবস্থা অনুশীলনকারী কোম্পানিকে অবশ্যই টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে।"
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান মনে করেন, আইনটি পাশ হলে কী ধরণের ইমপ্যাক্ট বাংলাদেশের রপ্তানিতে আসে, তা কিছুদিন পর বুঝা যাবে। তিনি বলেন, "বড় ধরণের ইমপ্যাক্ট না হলেও খরচ বেড়ে যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "কমপ্লায়েন্স বা এনভায়রনমেন্টাল বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে অনেক এগিয়েছি। বিশ্বের বেস্ট প্র্যাকটিস এবং গ্রিন কারখানা এখন বাংলাদেশে। গণহারে কেউ বলতে পারবে না, এখানে গুড প্র্যাকটিস নেই। যেসব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে, আমরা সেখানে কাজ করছি।"
পোশাক খাতে এনভায়রনমেন্ট নিয়ে কাজ করেন, এমন একজন বিশেষজ্ঞ টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন দেশ এখন সাপ্লাই চেইনকে কমপ্লায়েন্ট করতে নতুন নতুন আইনকানুন নিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের মত করে নিয়মকানুন আনছে। এতে ঝামেলা এবং ব্যয় বাড়বে। কিন্তু বাড়তি ব্যয় কোত্থেকে আসবে, তার কোন মেকানিজম নেই। কেননা বায়াররা প্রতিনিয়ত কম দামে কিনতে চায়।
আবার একেক দেশ একেক নিয়ম নিয়ে আসায় জটিলতাও বাড়বে। তার চেয়ে বরং একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন আসা যৌক্তিক বলে মত দেন তিনি।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ডক্টর এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, "সাপ্লাই চেইনে যেসব দেশের ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা ভালো, তাদের জন্য এই নতুন আইন সমস্যা তৈরি করবে না। এখানকার সাপ্লাই চেইনের বড় একটি অংশের ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা কিংবা সুশাসনে দুর্বল থাকায় বাংলাদেশ এ দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। যথাযথ ডকুমেন্টশন থাকলে অনিয়মের সুযোগ কমে যায়।"
তবে এ ব্যবস্থায় এগিয়ে যেতে পারলে বাংলাদেশ অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে যাবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলোকে ম্যাপিং নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য ১২ মাস সময় দেওয়া হবে (প্রভাব প্রকাশের জন্য দেওয়া হবে ১৮ মাস)। যদি তারা আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের বার্ষিক আয়ের ২ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। এই জরিমানা পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগ পরিচালিত নতুন একটি তহবিলে চলে যাবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পে তা ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল নন-কমপ্লায়েন্ট বা সম্মতি দেয়নি এমন কোম্পানিগুলোর একটি বার্ষিক তালিকাও প্রকাশ করবেন।
স্টেট সিনেটর আলেসান্দ্রা বিয়াগি এবং অ্যাসেম্বলিওম্যান অ্যানা আর কেলেসের স্পন্সর করা এ আইনটি বিশ্বব্যাপী পোশাক ও পাদুকা কোম্পানিগুলোর জন্য প্রযোজ্য হবে। এই কোম্পানিগুলো নিউইয়র্কে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবসা করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সিনেটর বিয়াগি এক বিবৃতিতে বলেছেন, "এই আইনটি শ্রম, মানবাধিকার এবং পরিবেশগত সুরক্ষার দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া বিষয়টি নিশ্চিত করবে।"
সোর্সঃ
THE BUSINESS STANDARD
No comments:
Post a Comment