#আমি_একজন_ইঞ্জিনিয়ারের_বউ_আপনাদের_কিছু_কথা_বলতে_চাই।
আমাদের বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও এখানে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে সেদেশের শিল্পের উপর নির্ভরশীল। আর সেই শিল্প কারখানা প্রায় সকল কাজ নিজের হাতে করে থাকে আমাদের দেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও বি এস সি ইঞ্জিনিয়ার ভাই বোনেরা।
আর এই মাধ্যমেই আমাদের দেশ বিশ্ব দরবারে নতুন পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করছে। কিন্তু রাত দিন কাজ করা ইঞ্জিনিয়ারদের একটি পরিবার আছে সেটা মাঝে মাঝে ভূলে যায় এই সকল ইন্ডাস্টিরির মালিক কর্মকর্তাগন। মাঝে মাঝে ডিউটির শুরু আছে শেষ নেই।
আমার স্বামী একজন দক্ষ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তাকে নিয়ে আমি গর্বিত তবে তার প্রতি আমার কিছু অভিযোগও আছে তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরব। বেশীর ভাগ মানুষ মনে করে ইঞ্জিনিয়ারে বউ অনেক সুখে আছে, এর পিছনে কতটুকু হাহাকার, বুকের মাঝে জমে থাকা কষ্টের কথা, বোবা কান্নার কথা কেউ জানে না। আমি একজন দক্ষ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের বউ। বিবাহের বয়স তেমন বেশিদিন হয়নি। এইতো ৫-৬ দিন পরে ১বছর পূর্ণ হবে।
জন্ম,বিয়ে,মৃত্যু এই ৩টি তো সবার জীবনেই আসে তাই আমরা সবাই জানি এই ধাপের অনুভূতি কেমন হয় সবার কাছে! আনন্দ,স্বপ্ন,স্বপ্নপূরন আর বিষাদের ধাপ এই ৩ টি। বিবাহকে ঘিরে সবার এক অন্যরকম আনন্দ,অনুভুতি আর স্বপ্ন কাজ করে সবার মাঝে। বিয়ের প্রথম ১-২ বছর হাসতে,খেলতেই পার হয়ে যায়।
আমি ১-২ বছরের কথা বাদ দিলাম, বিয়ের প্রথম ৬ মাস টাই বিবেচনা করি! যদি ইঞ্জিনিয়ারের ছাড়া অন্য যে কোন পেশার ব্যাক্তিকে বিবাহ করতাম তাহলে নিশ্চয় বিয়ের প্রথম বছরটা ঘুরতে, রেস্টুডেন্টে খেতে, হাসতে খেলতে পার করতে পারকরে দিতাম। কিন্তু আমি বিয়ে করেছি একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে, কোনো রক্ত মাংসের মানুষকে নয়!
এটাই আমার জীবনে বড় দুঃখের বিষয় যে মানুষকে বিয়ে করতে পারি নাই বিয়ে করেছি ইঞ্জিনিয়ারকে। এখন আপনারা হয়তো বলবে সব পেশার মানুষকেই কাজ বা চাকরি করেই চলতে হয়। আপনারা উদাহরণ সরুপ সরকারি, বেসরকারি চাকরি, প্রবাসী,পুলিশ, আর্মি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী,সাংবাদিক, ডাক্তার সহ অনেক পেশা দেখাবেন এবং বলবে এরাওতো চাকরি করে তাদের সংসার করছে। আমি কারো সাথে কোনো বিতর্কে যেতে চাই না, শুধু আমাদের বিয়ের পর আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর জীবনযাপনের কিছু রুটিন নমুনা তুলে ধরছি তাতেই বুজতে পারবেন।
বিয়ের সময় তার ছুটি ছিলো টোটাল ৬ দিনের বিহাবের আগে পরে মিলে। বিয়ের একদিন পর থেকে দেখছি সে ফোনে ফোনে অফিস করছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করছে বিভিন্ন সাজেশন দিচ্ছে। প্রোডাকশন, অপারেটর, জেনারেটর, ইউপিএস, পিএফ আই, ভোল্টেজ কম বেশী ইত্যাদি ইত্যাদি হিসাব নিকাশ বিভিন্ন কলিলদের সাথে।
বিয়ের ছয় দিন কেটে গেলো। বিয়ের পর পর রোজার মাস আসলো। সেই মাসের প্রথম দিন অনেক অফিসেই তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে দেয়। এই ছুটি বাধ্যতামূলক আমি সেটা বলছি না, কিন্তু অনেক অফিসই এই ছুটি দেয় আমার জানামতে। আর এই সেক্টরে চাকরিতে রোজার ছুটির দিনেও অফিস করতে হয় কারন ঈদের সময় বেশি কাজের অডার থাকে কাজ বেশী করতে হয়।
তাদের ভাষায় একে বলে বদলি ডিউটি। ঈদের ছুটি আপনাকে ৭ দিন দিবে তাই রোজার একমাস আপনাকে কাজ করতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও। রোজার মাসে কোন ছুটি ছাটা নেওয়ার সুযোগ নেই, শুধু মাত্র আসুস্থতা জনিত কারনে ছুটি কাটাতে পারবে। স্বামীকে সাথে নিয়ে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে ঈদ শপিং করার চিন্তা আগেই মারা গেলো।
বেশির ভাগ অফিসগুলো শুরু হয় সকাল ৮.০০ টায়। অফিসে তাদের আইডি কার্ড বা ফিঙ্গার পাঞ্চ করতে হবে ঠিক ৮.০০ টার পূর্বে। এক সেকেন্ড দেরি হলেই সেটা অফিস লেট বলে গন্য করা হয়। এভাবে মাসে ৩ দিন অফিস লেট করলে এক দিনর বেতন ভেনিস হয়ে যায় এবং বিনিময়ে একদিনের বেতন কেটে নেওয়া হয়।
৮.০০ টায় অফিস তাই তাকে বের হতে হয় সকাল ৫.৩০ মিনিট – সকাল ৫.৪৫ মিনিট মধ্যে। সকালের কাজ শেষ করে তাকে দৌড় দিতে হয় অফিসের দিকে বেশী দেরী করলে রাস্তায় জানজট বেধে যাবে। যে মানুষটা বাসা থেকে বের হয় ৭.০০ এম-৭.১৭ এম এর মধ্যে, সে একই মানুষ বাসায় ঢুকে রাত ৯ টার পরে কখনো কখনো ১০ টার পরও বাসায় পৌছে। বাসায় আসা মাত্রই তাড়াতাড়ি মুখ হাত পা ধুয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয়।
কারণ পরদিন আবার সেই কোকিল নামক কাক ডাকা ভোরে উঠতে তিনাকে অবার দৌড় দিতে হবে তাই সারাদিন বাসায় একা বসে থেকেও তার সাথে কথা বার্ত বলতে পারি না। তিনার পরিবার, বউ, পরিজন আছে তাদের সাথে সময় কাটাবে, সংসারের টুকিটাকি খোঁজ খবর নিবে সে সময় ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কি আছে?
সত্যি কথা বলতে কি এতো কাজের প্রেশার ও মানুষিক প্রেশার নেওয়ার পর একটা মানুষের আর ধৈর্য থাকে বাকি দুনিয়ার খোঁজ খবর নেওয়ার? আমরা যারা চাকরি করি তাদের মে দিবস,শবে বরাত, লাইলাতুর কদর ইত্যাদি কত ছুটি রয়েছে। ওরাও ঐদিনে এই ছুটিগুলো পায় কিন্তু তার বিনিময়ে তাদের ছুটির দিনে অফিস করতে হয়। অচ্যুয়াললি তাদের কোনো ছুটিই নেই।
কারণ প্রতিটা সরকারি অথবা উপলক্ষের ছুটি তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজের বিনিময়ে হয়। এখন আসি অন্য প্রফেশন নিয়ে কিছু কথায়। যারা প্রবাসে থাকে তাদের জীবনও খুব কষ্টের। কিন্তু তারা যখন দেশে আসে ওই সময়টা কিন্তু শুধুই তাদের পরিবারের। যারা আর্মিতে আছে যতদূর জানি তাদেরও কয়েকমাস পর পর একটা লম্বা ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু যারা টেক্সটাইলে আছে তাদের লম্বা কোনো ছুটি নেই।
সিক লিভ, এনুয়াল লিভ এই হাবিজাবি ১৫-১৯ দিনের আছে ছুটি আছে শুধু। আর যতবাকি ছুটি নিবেন সেটা বেতনের বিনিময়ে। কথা হচ্ছে এই দেশে ইঞ্জিনিয়ার চাকরির শুরুর দিকে বেতনের যা অবস্থা থাকে, সেটার থেকে যদি আবার কেটে রাখে তাহলে তো কিছুই বলার নেই।
বর্তমানে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করেছে। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গার্মেন্টস শিল্পই বদলে দিবে বাংলাদেশকে। এখন আপনারা নিজেরাই বলেন যে শিল্প একাই একটা দেশকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই শিল্পের মানুষগুলোকে আমরা কতটা মানুষ হিসেবে মনে করছি? আমাদের সরকার কতটা ভাবছে সেই মানুষগুলোকে নিয়ে? পোশাক শিল্পে নরমাল শ্রমিকরা যতটা স্বস্তি ফেলতে পারে, একজন ইঞ্জিনিয়ার তার সিঁকিভাগও শ্বাস ফেলতে পারে না।
দেশের উন্নয়নে এতো বেশি ভূমিকা রেখেও এরা কিছুই পাচ্ছে না, উল্টো পরিবার থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য কোনো এক প্রফেশনের মতো এরাও পরিবার পরিজন রেখে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় সরকার ভাবুন, এদের নিয়েও কিছু একটা ভাবুন। বড় কিছু করতে না পারেন, তারপরও সামান্য কিছু হলেও ভাবুন।